Śrī Śrīmad Bhaktivedānta Nārāyana Gosvāmī Mahāraja  •  100th Anniversary

Sripad B.B. Bodhayan Maharaja

India, Mayapur, Gopinath Gaudiya Math


শ্রীল ভক্তিবেদান্ত নারায়ণ গোস্বামী মহারাজের আবির্ভাব শতবর্ষে তাঁহার শ্রীচরণপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ।

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রী শ্রীমদ্ভক্তিবেদান্ত নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের এক মহান আচার্য্য ছিলেন। তাঁর গুরুদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ অষ্টোতরশত শ্রী শ্রীমদ ভক্তি প্রজ্ঞান কেশব গোস্বামী মহারাজের মিশনে যোগদান করার পর শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ সর্বদা বৈষ্ণব সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। তাঁর হরিকথায় শ্রবণ করেছিলাম, তাঁর গুরুদেব তাকে প্রথম আমার গুরু পাদপদ্ম শ্রীল ভক্তি প্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুরের সেবায় নিযুক্ত করেছিলেন। শ্রীল মহারাজ প্রায়শই একটি লোটা সম্পর্কিত ঘটনা উল্লেখ করতেন। ১৯৪৭ সালে আমার গুরুদেব চিনসূরা উদ্ধারণ গৌড়ীয় মঠে অবস্থান করছিলেন। বর্তমানে উক্ত মঠটি শ্রীদেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। সে সময় শ্রীল কেশব গোস্বামী মহারাজ শ্রীল নারায়ণ মহারাজ কে আমার গুরুদেবকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তখন শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ গৌরনারায়ণ দাস ব্রহ্মচারী নামে পরিচিত ছিলেন। আমার গুরুদেব শ্রীল পুরী গোস্বামী মহারাজ প্রতিদিন গঙ্গাঁ স্নানে যেতেন। উদ্ধারণ গৌড়ীয় মঠের নিকটেই গঙ্গা ছিল, এবং শ্রীল গৌরনারায়ণ ব্রহ্মচারী ওনাকে সহযোগিতা করার জন্য ওনার সাথে গঙ্গাস্নানে যেতেন। শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ তাঁর পূর্বাশ্রম থেকে একটি লোটা নিয়ে এসেছিলেন এবং প্রতিদিন সেই লোটাটি নিয়ে গঙ্গা স্নানে যেতেন। একদিন গঙ্গার স্রোতে লোটাটি ভেসে যাই এবং তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে পড়েন। সে সময় আমার গুরুদেব তাকে বলেছিলেন, “যদি একটি লোটার প্রতি এত আসক্তি থাকে তাহলে কৃষ্ণের প্রতি কিভাবে আসক্তি হবে? পারমার্থিক অনুশীলনের দ্বারা কৃষ্ণ সেবায় মনঃস্থির করার জন্যই আমরা এখানে এসেছি।” আমার গুরুদেবের আবির্ভাব অথবা তিরোভাব উৎসবে উনি সবসময় এই ঘটনাটি বর্ণনা করতেন।

শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজের সৌজন্যপূর্ণ সেবা ভাব অন্যান্য ভক্তদেরকেও আন্তরিকভাবে সেবা করতে অনুপ্রাণিত করত। আমি লক্ষ্য করেছি তাঁর মঠের সকল ভক্তবৃন্দ মনোযোগ সহকারে হরিকথা শ্রবণ করেন। হরিকথাই হলো পারমার্থিক অনুশীলনের প্রধান অংশ বা হৃদয়। আমার পরম গুরুদেব শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর বলতেন, যদি কোন ব্যক্তির হরিকথায় রুচি না থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির পক্ষে কখনোই গুরুদেবের আনুগত্যে মঠ বাস করে ব্রহ্মচর্য্য পালন করা সম্ভব নয়। শ্রীল মহারাজের শিষ্যগণের এই প্রবণতা আমাকে সর্বদা আনন্দিত করে।

আমার গুরুদেবের আবির্ভাব এবং তিরোভাব উৎসবে মহারাজকে আমন্ত্রণ জানালে, উনি সর্ব্বদা উৎসবে যোগদান করতেন, শ্রীল পুরী গোস্বামী মহারাজ শ্রীল প্রভুপাদের মিশনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা করতেন- একটি ‘মৃদঙ্গঁ’ এবং অপরটি ‘বৃহৎ মৃদঙ্গঁ’। মৃদঙ্গেঁর মাধ্যমে কীর্তন সেবার কথা বলতেন এবং বৃহৎ মৃদঙ্গেঁর দ্বারা তিনি শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে অসংখ্য বৈষ্ণব গ্রন্থ প্রণয়ন করতেন।

আমার গুরুদেবের অপ্রকটের এক বছর পর আমার দুই গুরুভ্রাতা শ্রীপাদ মাধবপ্রিয় প্রভু ও শ্রীপাদ কৃষ্ণকৃপা প্রভুর (বর্তমানে শ্রীল ভক্তিবেদান্ত সিদ্ধান্তি মহারাজ নামে পরিচিত) অনুরোধে আমি তাদেরকে মথুরায় শ্রী কেশবজী গৌড়ীয় মঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা উভয়েই শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলেন। শ্রীল মহারাজ আনন্দের সহিত তাদের গ্রহণ করলেন। বর্তমানে তারা অতি সুন্দর ভাবে আমাদের গৌড়ীয় মিশনের সেবা করছেন। শ্রীল মহারাজ কখনোই তাঁর নিজের শিষ্যগণের থেকে আমার গুরুদেবের শিষ্যগণকে কোন বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দর্শণ করতেন না। সকলকে তিনি সমানভাবে শিক্ষা দিতেন। এমনই ছিল শ্রীল মহারাজের মহানুভবতা ও উদারতা।

আমি লক্ষ্য করতাম যখনই আমি শ্রীল মহারাজের নিকট কোন প্রশ্ন নিয়ে যেতাম, উনি অত্যন্ত যত্নের সহিত সেই প্রশ্নের সমাধান করতেন। মনে হতো আমার গুরু পাদপদ্ম তাঁর শ্রীমুখ নিঃসৃত বানী দ্বারা আমাদের শিক্ষা প্রদান করছেন। যাইহোক, পারমার্থিক সম্পর্কের বিচারে আমি শ্রীল মহারাজের গুরুভ্রাতা সম, সে কারণে তিনি সর্বদা আমাকে তাঁর সামনে চেয়ারে বসতে অনুরোধ করতেন। কিন্তু আমি চেয়ারে বসতে লজ্জিত অনুভব করতাম এবং দৈনভরে বলতাম,-“মহারাজ আপনি যখন গৌড়ীয় মঠে যোগদান করেছিলেন তখন আমি জন্মগ্রহণ করিনি। কিভাবে আমি আপনার সামনে চেয়ারে বসতে পারি? আপনার শ্রীচরণপদ্মে আমাকে বসার অনুমতি দিন।” যদিও শ্রীল মহারাজ কোনভাবেই তাতে সম্মত ছিলেন না, তথাপি তিনি কোনদিন আমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করেননি। সর্ব্বদা তিনি আমার ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করতেন।

শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভক্তগণ মধ্যে নির্বিশেষে সকলকে শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর, শ্রীল রুপ গোস্বামীপাদ, শ্রীল রঘুনাথদাস গোস্বামীপাদের শিক্ষাকে উদাহরণ স্বরূপ নিবেদন করতেন। উজ্জ্বল নীলমণি, গোবিন্দ লীলামৃত, চমৎকার চন্দ্রিকার মত কিছু সংস্কৃত ভাষার দুর্লভ বৈষ্ণব দর্শন শাস্ত্র সম্মূহ বাংলা ও হিন্দি ভাষায় সহজলভ্য ছিল। বর্তমানে শ্রীল নারায়ন গোস্বামী মহারাজের কৃপাশীর্বাদে এই সমস্ত দুর্লভ গ্রন্থসমূহ ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষাতেও রচিত হয়েছে। যে সমস্ত পারমার্থিক ভাবে আন্তরিক এবং অনুসন্ধিৎসু ভক্তগণ গুরুবর্গদের শিক্ষায় এবং শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণের লীলারস আস্বাদনে আগ্রহী, তাঁরা শ্রীল নারায়ন গোস্বামী মহারাজের প্রকাশনার নিকট কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন।

আমার প্রতি শ্রীল মহারাজের সহজ-সরল মনোভাব প্রশংসনীয়। একটি ঘটনা আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠছে। ২০০৮ সালে শ্রীল মহারাজের কিছু অনুগামীগণ তাঁকে জানিয়েছিলেন যে আমি তাঁর প্রতি সন্তোষজনক নয়। উনি কার্তিক পূর্ণিমার পর গোবর্ধনে তাঁর মঠে ডেকে পাঠালেন। তখন প্রায় বিকাল ৪টা হবে। আমি শ্রীল মহারাজের দর্শন লাভ করলাম। তিনি প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি আমার কাছে আসেন না কেন? সকলেই তো আসেন কিন্তু আপনি তো আসেন না।” তখন আমি উত্তরে বললাম, “মহারাজ, আমি সেবা থেকে বিরত হওয়ার সময় পাই না। শ্রীল গুরুদেবের অপ্রকটের পর সমস্ত মঠ গুলি পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।” তখন তিনি বললেন, “আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আমি শুনলাম আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট নন। কৃপাপূর্বক আমার ভক্তগণ ভক্তিবেদান্ত মাধব মহারাজ এবং অন্যান্যদের সাথে কথা বলুন।” এই ঘটনার পর শ্রীল মহারাজের সহজ-সরল মনোভাবের প্রতি আমি পরম শ্রদ্ধা অনুভব করিলাম। আমার মত এক কনিষ্ঠ অযোগ্য গুরুভ্রাতার প্রতি তাঁর কৃপা আশীর্ব্বাদে আমি পরম সুখ অনুভব করলাম। তারপর, আমি বৃন্দাবনে আমাদের দাওজী মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করলাম।

২০০৯ সালে আরো একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। সকাল ১১টা। আমি ৩০’জন কানাডিয়ান ভক্তগনের সহিত গোবর্ধন পরিক্রমা করছিলাম। সে সময় আমি জানতে পারলাম শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ ওনার গোবর্ধন মঠে অবস্থান করছেন। আমি ভক্তগণের সহিত মহারাজের দর্শনে গেলাম। শ্রীল মহারাজের সেবকগণ কৃপাপূর্বক আমাকে এবং বিদেশী ভক্তগণকে শ্রীল মহারাজের দর্শনের অনুমতি দিলেন। আমি মহারাজের দর্শনের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার নিকট মাত্র ৫০০ টাকা ছিল। বিদেশি ভক্তগণ চলে যাওয়ার পর আমি ৫০০ টাকা প্রনামী দিলাম। সে সময় শ্রীল মহারাজ রসিকতা করে বললেন, “আমি আপনার থেকে ৫ লক্ষ টাকা আশা করেছিলাম।” আমি বললাম, “মহারাজ, এই মুহূর্তে আমার কাছে আর কিছু নেই। কৃপা করে আমার সন্তুষ্টির জন্য এইটুকু গ্রহণ করুন।” তখন তিনি আনন্দের সহিত সহাস্যবদনে তা গ্রহণ করলেন। শ্রীল মহারাজের সহিত গভীর ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতাম।

একসময় জগন্নাথ পুরী ধামে শ্রীল মহারাজ অসুস্থ লীলাভিনয় করেছিলেন। আমার গুরুদেবের আবির্ভাব উৎসবের দু’দিন আগে আমি শ্রীল মহারাজের নিকট উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলাম। শ্রীল মহারাজের সেবকগণ বললেন, উনি অসুস্থ, উনি উৎসবে যোগদান করতে পারবেন না। কিন্তু শ্রীল মহারাজ তৎক্ষণাৎ বললেন, “আমি উৎসবের দিন ১০টার সময় যাব। দু’দিন পর, উৎসবের দিন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির জন্য আমরা যথাযথভাবে মঞ্চ প্রস্তুত করতে পারলাম না কিন্তু শ্রীল মহারাজ ঠিক দশটার সময় ২০জন ভক্তগণের সহিত আমাদের মঠে উপস্থিত হলেন, তারপর হরিকথা অনুষ্ঠান শুরু হল। তাঁর মহিমান্বিত হরিকথায় সকলেই অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। উৎসবের শেষে শ্রীল মহারাজ আমাকে বললেন, “মহারাজ, প্রসাদে আমার কিছু বিধি-নিষেধ আছে কিন্তু আমার ভক্তগণ এখানেই প্রসাদ গ্রহণ করবে।” তারপর, মহারাজের ভক্তগণ প্রসাদ সেবন করলেন এবং উনি প্রত্যাবর্তন করলেন।

শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলতেন, “সরলতার অপর নাম বৈষ্ণবতা।” এই সমস্ত ঘটনা আমাকে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের বাণী স্মরণ করিয়ে দেয়। শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ অন্তঃকরন থেকে সরল প্রকৃতির ছিলেন। ২০১০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকান ভক্তগনের দ্বারা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আমি একটি নীরব ধর্মীয় পান্থনিবাসে অবস্থান করছিলাম। কয়েক মাস আগে শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজও সেখানে গিয়েছিলেন। সে কারণে সমস্ত ভক্তগণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী ছিলেন। একদিন ভোর ৩টের সময় ভক্তগণ আমার দরজায় ধাক্কা দিয়ে আমাকে ডেকে বললেন, “শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ নিত্যলীলায় প্রবেশ করেছেন।” এই সংবাদটি শ্রবণ করা মাত্রই আমি অনুভব করলাম সমগ্র গৌড়ীয় সমাজ আরো এক অভিভাবককে হারালেন। যাইহোক, আমি বিশ্বাস করি, উনি সর্ব্বদা আমাদের সাথেই আছেন এবং পারমার্থিক অনুশীলনের পথে সমস্ত বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করছেন। শ্রীল ভক্তিবেদান্ত নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ গৌড়ীয় গগনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্য্যগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। শ্রীল মহারাজের শতবার্ষিকী উৎসব-অনুষ্ঠানে শ্রী গোপীনাথ গৌড়ীয় মঠের ভক্তগনের পক্ষ থেকে তাঁর শ্রীচরণ কমলে অহৈতুকী কৃপা আশীর্ব্বাদ প্রার্থনা করি যেন বাকি জীবন গুরু, বৈষ্ণব, ভগবানের সেবায় অতিবাহিত করতে পারি। যখনই আমি শ্রীল মহারাজকে দর্শন করেছি, উনি সর্ব্বদা হরিনামের মালায় জপ করতেন। আমি বিশেষভাবে তাঁর শ্রীচরণপদ্মে প্রার্থনা জানাই যেন তাঁর মত বাকি জীবন সর্ব্বদা হরিনাম মহামন্ত্র জপ করতে তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মিশনের সেবক,

শুদ্ধভক্তের চরণরেনুকাঙ্খি,

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের এক অযোগ্য সেবক

ভক্তি বিবুধ বোধায়ন

সভাপতি, শ্রী গোপীনাথ গৌড়ীয় মঠ

(Śrīmad Bhakti Bibudha Bodhayan Maharaja is the present ācārya of Gopinath Gaudiya Math)