Sripad B.V. Puri Maharaja
India, Nabadwip, Keshavji Gaudiya Math
শিক্ষাগুরুদেব শ্রী শ্রীমদ্ভক্তিবেদান্ত নারায়ণ গোস্বামী মহারাজের ১০০’তম আবির্ভাব পূজা বাসরে শ্রীচরণে দীনের ভক্তিপূর্ণ পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ
শিক্ষাগুরু পাদপদ্ম শ্রীল নারায়ণ গোস্বামী মহারাজ ইং-১৯২১ সন-এর মাঘ মাসে মৌনী অমাবস্যা তিথিতে বিহার প্রদেশান্তর্গত বক্সার জেলার অন্তর্গত (তিওয়ারিপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বা্লেশ্বরনাথ তিওয়ারি, সকল পুত্র-কন্যার মধ্যে গৌরনারায়ণ জ্যেষ্ঠ ছিলেন। বাল্যকালে প্রত্যহ গঙ্গা স্নান, আরাধ্যদেব পূজার্চনা ও রামচরিত মানস, হনুমান চলিশা ও স্তব স্তোত্র পাঠ তাহার নিত্যসেবা ছিল। উচ্চবিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন সমাপ্ত করে অতি অল্প বয়সে পুলিশ অফিসার পদে চাকুরী এবং সংসার পরিচালনা করেন। পিতা-মাতার আদেশে বিবাহ করেন ও তাহার তিন কন্যা সন্তান হয়। অন্য প্রসাদে অধিক রুচি হওয়ায় পিতাজী বলেন - “এ বাঙালী বাবা কাঁহা সে আয়া।” চাকুরী জীবনে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে একদিন,- তাহার হায়ার অফিসার ভিজিটিং-এ আসেন এবং তাঁহাকে দেখে তাঁহার কাজের দায়িত্ব ও নিয়মানুবর্ত্তিতার ভূয়সী প্রশংসা করে প্রমোশানের অর্ডার দেন। অথচ তিনি অফিসে ঐ দিন হাজির ছিলেননা। পরের দিন সকাল স্টাফ বন্ধুরা প্রমোশানের’জন্য তাকে ভূয়শী প্রশংসা করেন এবং বাধাই দেন। ইহাতে তিনি ভগবানের বিশেষ মহিমা উপলব্ধি করেন। পরম গুরুদেব শ্রীল ভক্তি প্রজ্ঞান কেশব গোস্বামী মহারাজের আদেশে সতীর্থ গুরুভ্রাতা নরোত্তমানন্দ প্রভু (শ্রীল ভক্তি কমল মধুসূদন মহারাজ) কতিপয় ব্রহ্মচারী সহ সাহেবগঞ্জে প্রচারার্থে যান ও প্রত্যহ শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ ব্যাখ্যা করেন। গৌর নারায়ন তিউয়ারী প্রত্যহ পাঠ শ্রবণ করেন, স্বয়ং ভগবান মহাপ্রভুর শিক্ষা ও ভাবধারা অর্থাৎ কৃষ্ণপ্রেম লাভই মনুষ্য জীবনের একমাত্র সার্থকতা ইহা উপলব্ধি করেন। পরম গুরুদেবের সাথে চিঠি পত্রের মাধ্যমে নিত্য প্রতিদিন হরিকথা,- প্রশ্নোত্তর ও উপোদেশ প্রাপ্ত করেন। মহৎ কৃপায় সংসারে বৈরাজ্ঞ হওয়াই পিতাকে আমার প্রমোশান হইয়াছে বলিয়া পত্র লেখেন এবং সরকারী চাকুরী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। পিতা সংসারের উন্নতি ও অর্থলাভ জেনে সুখি হলেন। অবশেষে তিনি স্ত্রী-কন্যা, ভাই-বোন, পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব, সরকারি চাকুরি সবকিছুর মায়ামোহ পরিত্যাগ করে অমৃতলোকের সন্ধানে যাত্রা করেন।
১৯৪৬ সনের একদিন মদীয় গুরুদেব সজ্জন সেবক ব্রহ্মচারী (বামন গোস্বামী মহারাজ) পরম গুরুদেবের আদেশে একটি লন্ঠন হাতে একাকী অধিক রাতে নবদ্বীপ ধাম স্টেশনে নির্জনে সাহেব গঞ্জের ট্রেন আসিলে,- আপ তেউয়ারী জী হ্যা? উত্তরে গৌর নারায়ন বলেন, ‘ম্যায় তেউয়ারী হুঁ,’- বলায় সাথে করে শ্রী দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠে কেশব গোস্বামী মহারাজের নিকট নিয়ে আসেন, গুরু-শিষ্যের সাক্ষাৎ মিলন হল। তিনি হিন্দিভাষী মঠের সকলে বাঙালী হওয়ায় কোনো সমস্যা হলে গুরুমহারাজ (সজ্জন সেবক প্রভু) সর্বতভাবে সহায়তা করেন। হরিনাম দীক্ষা লাভের পর শ্রী গৌর নারায়ন দাসাধিকারী নামে পরিচিত হন। তিনি প্রয়াশ বলতেন যে, কোন্ জরাসন্ধের মগধ দেশে আমার জন্ম গুরুদেবের অহৈতুকী কৃপায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবধারায় এসে উপস্থিত হয়েছি, গুরুসেবার জন্য ভিক্ষাদি সকলের থেকে অধিক সংগ্রহ করতেন, তার গুরুদেবের সাথে গ্রামে গ্রামে প্রচার কার্যাদিও করতেন। শ্রীল ত্রিবিক্রম মহারাজের নিকট (রাধানাথ দাসাধিকারী প্রভু) বাংলা ভাষায় কীর্তন, সুর, তাল, লয় শেখেন। ১৯৫২ সনে পরমগুরুদেব তাহাকে সন্ন্যাস দিতে চাইলে নিজেকে উহার অযোগ্য মনে করায় শ্রীল ভক্তি কুশল নারসিংহ মহারাজ বলেন, “যোগ্যা-যোগ্য” কি তুমি ঠিক করবে? গুরু যেমন সাজাবেন তেমনি সাজতে হবে ও ভাল-মন্দ সব তার উপর ছেড়ে সম্পূর্ণ শরণ গ্রহণ করাই হল গুরু নিষ্ঠা। তিনজনের একসাথে শ্রীল গৌর নারায়ন দাসাধিকারী অর্থাৎ শ্রীল নারায়ণ মহারাজ, শ্রীল সজ্জন সেবক প্রভু অর্থাৎ শ্রীল বামন মহারাজ ও রাধানাথ দাসাধিকারী অর্থাৎ শ্রীল ত্রিবিক্রম মহারাজ নামে সন্ন্যাস প্রাপ্ত করেন। পরম গুরুদেব কুড়ি-পঁচিশ সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী সহ বাংলা বিহার আসাম প্রভৃতি ভারতের সর্বত্র বিশাল ধর্মসভা ও নাম সংকীর্তন প্রচার করেন। নারায়ন মহারাজকে বক্তৃতা করতে বললে আধা বাংলা, আধা হিন্দি মিশিয়ে মধুর স্বরে সকলকে আনন্দ দিতেন। পরে পরে বাংলা শিখে পড়তেন তবে লিখতেন না। প্রধানত তিনি হিন্দি ভাষী হওয়ায় তাকে পরমগুরুদেব শ্রী কেশবজী গৌড়ীয় মঠ মাথুরায় সকল প্রকার দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি হিন্দিতে ভগবত পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেই থেকে তিনি ব্রজে বসবাস করেন ও মথুরা অঞ্চলে বিপুলভাবে প্রচার করেতেন। প্রতিদিন নিয়ম করে যমুনা স্নান, সংখ্যা পূর্ব্বক নাম-জপ, স্তব-স্তোত্র কীর্তন শ্রীমদ্ভাগবত, বৃহদ্ভাগবতামৃত প্রভৃতি বৈষ্ণব গ্রন্থ পাঠ প্রবচন এবং জৈব ধর্ম, গৌড়ীয় কন্ঠহারের শ্লোক মুখস্থ এবং সকলকে নিয়ে ক্লাস করতেন। তিনি নিজে ভজনানন্দী, তীব্র ভজন করতেন এবং অন্য সকল কে ভজন শেখাতেন।
পণ্ডিত বাসুদেব চতুর্বেদীর সাথে ভগবত আদি গ্রন্থের সংস্কৃত টিকার ব্যাখ্যা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতেন। মথুরায় অন্য গৌড়ীয় মঠ না থাকায় সকল মঠের বৈষ্ণবগণ শ্রীকেশবজী গৌড়ীয় মঠের আসতেন, মহারাজ নিজেই সকল বৈষ্ণবগণকে পরম আদরে সেবা-যত্নদি করতেন। “বৈষ্ণব দেখিয়া আদর করিবে হৃদয়ের বন্ধু জানি।” এই সময় শ্রীল পরমগুরুদেব কেশবগোস্বামী মহারাজের সতীর্থ গুরুভ্রাতা শ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর মহারাজ, হৃষীকেশ মহারাজ, নারসিংহ মহারাজ, ভক্তি ভূদেব মহারাজ সকল গুরুগম্ভীর তত্ত্ব সিদ্ধান্ত আলোচনা করতেন। সাধুসঙ্গের প্রভাবে সাধকের জীবের স্বরূপ পরিবর্তন হয় কিনা “সাধনে ভাবিবে যাহা সিদ্ধিতে পাইবে তাহা” পূজ্যপাদ শ্রীধর মহারাজ বললেন- মুরারী গুপ্তের শ্রী রামের প্রতি নিত্য দাস্য সেবাভাব মহাপ্রভুর কৃষ্ণভজনের আদেশেও অপরিবর্তনীয় ছিল। দক্ষিণ দেশ যাত্রায় মহাপ্রভুর আজ্ঞায় শ্রী বেঙ্কটভট্ট, ত্রিমল্লভট্ট, প্রবোদানন্দ সরস্বতীপাদ ও গোপালভট্ট সকলে লক্ষ্মী-নারায়নের উপাসনা ছেড়ে রাধা-গোবিন্দের উপাসনায় রত হন। জীব স্বরূপত কৃষ্ণদাস। নিত্যসিদ্ধ ও সাধকসিদ্ধ অবস্থা অনুসারে এই প্রকার দেখা যায়। মহাপ্রভুর ধারায় কৃষ্ণভজনে সহজে শীঘ্র স্বরূপ সিদ্ধি প্রাপ্ত হওয়া যায়। পরম গুরুদেব ইহাতে সম্মতি দেন। সুন্দর এক বাস্তব যুক্তি দিয়ে বলেন যে,- গঙ্গার তীরে আম, নিম, তেঁতুল বীজ বপন করে একই জল, বাতাস, মাটি সত্বেও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি, তিতা ও টকের স্বাদ যুক্ত ফল হয় অর্থাৎ যার যাহা Potency সেই মতো ফল প্রাপ্তি হয়। “যার যেই রস সেই সর্বোত্তম, নিরপেক্ষভাবে বিচারিলে আছে তারতম।” একদিন বাঙালি ঘাটে শ্রী অভয়চরণ প্রভুর (স্বামী মহারাজ) নারায়ণ মহারাজের দেখা হয়। তিনি তখন নিজের তৈরি চর্ম রোগের ঔষধ বিক্রির জন্য দোকানে-দোকানে, ঘরে-ঘরে বিলি করছেন। মহারাজ তাঁকে বললেন প্রভু আপনি ইংলিশে কতদক্ষ গুণী ব্যক্তি প্রভুপাদের গণ আপনি মঠে চলুন। এখনই সংসার ছেড়ে গুরুদেবের নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করুন এবং প্রভুপাদ ও মহাপ্রভুর বাণী সারাবিশ্বে প্রচার-প্রসার করুন, আমি সর্বোতভাবে আপনার সহায়তা করবো। শ্রী কেশবজী গৌড়ীয় মঠে বিশ্বরুপ সন্ন্যাস দিবসে পরম গুরুদেবের নিকট অভয়চরণ প্রভু ও সনাতন প্রভু সন্ন্যাস নিলেন। যথাক্রমে শ্রী ভক্তিবেদান্ত স্বামী মহারাজ ও শ্রী ভক্তিবেদান্ত মুনি মহারাজ নামে পরিচিত হলেন। স্বামী মহারাজের সন্ন্যাসের সকল ব্যবস্থা অর্থাৎ দন্ড নির্মাণ, বস্ত্র রঙ করা ও যোজ্ঞ-হবনাদি ক্রিয়া শ্রীল মহারাজ নিজেই করলেন। স্বামী মহারাজ কিছুদিন মথুরা থাকার পর প্রথম ঝাঁসিতে প্রচার করেন পরে দামোদর মন্দিরে (বৃন্দাবনে) থেকে গ্রন্থাদি ইংরাজিতে অনুবাদ করেন এবং ১৯৬৫ সনে জল-জাহাজে আমেরিকায় প্রচারে গমন করেন ও সারা বিশ্বে হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের দ্বারা ইসকন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশী গনকে কৃষ্ণ’নামে দীক্ষিত করেন। তাঁর আদেশে বিদেশে খোল, করতাল, শ্রীবিগ্রহ ও পূজা সামগ্রী মহারাজ বিদেশে পাঠাতেন। অন্তিম সময়ে স্বামী মহারাজ শিষ্যদেরকে নারায়ণ মহারাজের আনুগত্যে ভজন ও তাঁহার সমাধির সকল বিধি ব্যবস্থা করতে আজ্ঞা করেন। তদনুসারে স্বামী মহারাজের অপ্রকটের পর তিনি বৃন্দাবনে কৃষ্ণবলরাম মন্দিরে সমাধিস্থ করেন। পরবর্তীকালে স্বামী মহারাজের অপ্রকটের পর তাহার বহু শিষ্য সন্ন্যাসীর ভজন চুত্ত্যি হয়। শ্রীল মহারাজ ১৯৬৫ সানে স্বামী মহারাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিদেশ যাত্রা করেন ও তাঁহার বহু শিষ্যগণকে পুনঃরায় ভজনের পথে ফিরিয়ে আনেন। ইসকনে B.B.T কে নিয়ে স্বামী মহারাজের সাথে বম্বে হাইকোর্টে উত্তরাধিকারী কেস হয়। শ্রীল মহারাজ নিজেই কোর্টে উপস্থিত হয়ে স্বামী মহারাজের সন্ন্যাসের প্রমাণাদির সাক্ষ্য প্রদান করেন ও ইসকন B.B.T কে রক্ষা করেন। কিন্তু ইসকনের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও শ্রীল নারায়ন মহারাজ সারাবিশ্বে দীর্ঘ ১৫ বৎসর যাবৎ বিপুলভাবে মহাপ্রভুর রাগভক্তির প্রচার-প্রসার করেন, হাজার-হাজার শিষ্য ও মঠ-মন্দির করেন। এবং শ্রীল ভক্তি প্রজ্ঞান কেশব গোস্বামী মহারাজের মনোভিষ্ট পূরণ ও গৌড়ীয় বেদান্ত সমীতির নাম উজ্জ্বল করেন। ইহাতে মদীয় গুরুদেবের ভবিষ্যৎ বাণী স্থাপিত হল। তিনি শ্রীমদ্ভাগবত দশম স্কন্ধ, বেদান্ত সূত্র, বৃহৎভাগবতামৃত, উজ্জ্বলনীলমণি, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, গীতগোবিন্দ, শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী পাদের টিকার ভাবানুবাদ সহ শ্রীমদ্ভগবদগীতা, জৈবধর্ম, শ্রীল কেশব গোস্বামী মহারাজের জীবন চরিত প্রভৃতি শতাধিক গ্রন্থ প্রধানত হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। পরে বিশ্বের নানা ভাষায় অনুবাদিত হয়। গৌড়ীয় বেদান্ত সমিতির তিনি সহ-সভাপতি ও পরে সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন ১৯৬৮ সানে। গৌড়ীয় বেদান্ত সমিতির তিন স্তম্ভ সরূপ পরম গুরুদেবের তিন রত্ন শ্রীল গুরুদেব বামন গোস্বামী মহারাজ ব্রহ্মা রূপে সৃজন অর্থাৎ শিষ্য ও গৌর বাণী প্রচার প্রসার করেন। শিক্ষা গুরুদ্বয় যথাক্রমে শ্রীল নারায়ণ মহারাজ বিষ্ণুরূপে অর্থাৎ গুরুভ্রাতা ও বামন মহারাজের শিষ্যগনকে ভজন শিক্ষার দ্বারা পালন পোষণ করেন, এবং শ্রীল ত্রিবিক্রম মহারাজ শিব রূপে সংহার অর্থাৎ ভোগবাদ, অনর্থ, দুঃসঙ্গ, কামনা-বাসনা ও প্রতিষ্ঠার পিপাসা বিনাশের দ্বারা সকল মঠবাসী গণের মঙ্গল বিধান করেন। শ্রীল মহারাজ সমিতির দক্ষ প্রশাসক রুপে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতেন। বিশেষত তাহারই আনুগত্যে প্রতি বৎসর ব্রজমন্ডল পরিক্রমা ও নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমাদি যথা- সংকীর্তন সহযোগে পরিক্রমা, ধাম মহিমা কথা, কীর্তন, হরিকথা, ধর্মসভা ও প্রসাদ সেবা হাজার হাজার দেশি-বিদেশি ভক্তবৃন্দকে সমিতি ও ট্রাস্ট দ্বারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন। তিনি সমিতির বিভিন্ন মঠ মন্দির ও শ্রী দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের নাট মন্দির, ধর্মশালা ও স্কুল বিল্ডিং নির্মাণ করে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। শ্রীল মহারাজ গৌড়ীয় বেদান্ত সমিতি ট্রাস্টের সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক গৌড়ীয় বেদান্ত ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ছিলেন। শ্রী শ্রী কেশবজী গৌড়ীয় মঠ (নবদ্বীপ ধাম) সহ গোবর্দ্ধন, বৃন্দাবন, দূর্ব্বাসা টিলা, কলিকাতা, শিলিগুড়ি, পুরী, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর প্রকৃতি ভারতে ও বিদেশের বিভিন্ন দেশে মঠ মন্দির ও পারমার্থিক প্রচার কেন্দ্র নির্মাণ করেন। ব্রজমণ্ডলে উদ্ধব কেয়ারী, টের-কদম্ব, জাবট,কালিয়দহ এবং কুন্ডাদি বিলুপ্ত তীর্থ পুনরুদ্ধার ও সংস্কারাদি ধাম সেবা করেন। ইহাতে শ্রীমতি রাধারানী প্রসন্ন হয়ে শ্রীল নারায়ণ মহারাজ কে স্বপ্নে সেবাকুঞ্জের পূজারী কে নির্মাল্য প্রসাদ প্রদান করতে আদেশ দেন। তিনি সর্বদা রাধাভাবে বিভাবিত উচ্চকোটি ব্রজের রসিক মহাভাগবত শ্রীরাধা-ঠাকুরানী ও বিনোদ মঞ্জরীর প্রিয় রমণ মঞ্জরী ছিলেন। তাহার হরিকথা মাধুর্য্যময় শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ব্রজলীলা এবং রূপ সনাতন দাস গোস্বামী ও বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর গোস্বামী গণের ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত। শ্রীকৃষ্ণ পরতত্ব হলেও শ্রীমতি রাধারাণীর প্রেমের অধিন ও বশীভূত ইহাতেই তাহার আনন্দ হয়। তাহার মধুর হরি কথার আকর্ষণে অন্যান্য গৌড়ীয় মঠের সেবকগণ ও শিক্ষাগুরু রুপে চরনাশ্রয় ও ভজন করেছেন। ভেদ ভাব শূন্য হয়ে তিনি সকলকে স্নেহ যুক্ত শিক্ষা প্রদান করতেন। মাঠবাসি তাহার সকল গুরু ভ্রাতাগণ ও শিক্ষাগুরু রুপে স্বীকার করেন। সেই সময় গৌড়ীয় গগনে তিনি সম্প্রদায় সংরক্ষক অর্থাৎ পরমত খণ্ডন-মণ্ডন স-মত স্থাপন, বিশেষত রাধাকুণ্ড’বাসী সহজিয়া বাবাজি গণের নিকট যম সদৃশ বলিষ্ঠ শ্রেষ্ঠ আচার্য গনের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র বিশেষ ছিলেন। তাহার লিখিত প্রবন্ধ পঞ্চকম গ্রন্থ সহজিয়া অপসম্প্রদায়ের যম দণ্ড বিশেষ। তাহার তিন প্রধান সেবক শ্রীপাদ প্রেমানন্দ সেবারত্ন, শুভানন্দ ভাগবত ভূষণ ও বিশ্রম্ভ সেবক নবীন কৃষ্ণ বিদ্যালঙ্কার তিন রত্ন রূপে প্রকাশিত, তন্মধ্যে সকলের প্রিয় শুভানন্দ প্রভু অর্থাৎ শ্রীপাদ তীর্থ মহারাজ নিত্যলীলায় গুরুদেবের নিত্য সেবায় নিযুক্ত রয়েছেন। প্রেমানন্দ প্রভু বৃন্দাবনে রাধাকুঞ্জে গুরুদেবের অন্তরঙ্গ সেবা প্রকাশ ও প্রচার প্রসার করছেন। নবীন কৃষ্ণ প্রভু অর্থাৎ শ্রীপাদ মাধব মহারাজ বর্তমানে মঠ-মন্দির পরিচালনা, পরিক্রমাদি, গ্রন্থ প্রকাশন ও প্রচার প্রসার সকলকে সাথে নিয়ে করছেন। “এক আত্মা তিন দেহ ধরি”- কেশব ধৃত বামন রূপ, কেশব ধৃত নারায়ন রূপ, কেশব ধৃত ত্রিবিক্রম রূপ, একজনের শরীর অসুস্থ হলে তিনজনে একসাথে অসুস্থ লীলা করেন। এই প্রকার অভিন্ন হৃদয় গুরুবর্গ জগতে বিরল তজ্জন্যে শ্রীল নারায়ন মহারাজ মদীয় গুরুদেবের আবির্ভাব পৌষী কৃষ্ণানবমী তিথিতে নিশান্তে শ্রী রাধাবিনোদ বিহারী ও শ্রী রাধারমন বিহারীর নিত্য নিকুঞ্জ সেবায় নিযুক্ত হলেন। (২০১০ সনের ২৯ ডিসেম্বর পুরী ধামে)।
১৯৭১ সনে শ্রীল নারায়ন মহারাজ নবদ্বীপ ধামস্থ শ্রী দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠে অবস্থান কালে ১০ বছর বয়সে আমার মঠে আসা হয়। মহারাজের ভজন কুটিরের পাশেই হল ঘরে থাকায় প্রচুর স্নেহাশীর্বাদ ও সেবার সুযোগ লাভ করি। মহারাজ সংস্কৃত পড়তে বলায় চতুষ্পাটিতে বসতাম। প্রতিদিন তিনি শ্লোক পড়াতেন না পারলে কান ধরে দাঁড় করাতেন। আমাকে সাথে করে বারবার মন্ত্রের ন্যায় আবৃত্তি করাতেন। মঙ্গলারতিতে না গেলে বিছানায় জল ঢেলে দিতেন, ও জল খাবার দিতেন না। সকলকে কীর্তন শেখাতেন এবং মধুর কন্ঠে ভাগবতাদি শ্রবণ করাতেন। বিশেষত- জৈবধর্ম, শিক্ষাষ্টক, উপদেশামৃত, মনঃশিক্ষা প্রভৃতি ভজন শিক্ষামূলক গ্রন্থাদি ক্লাস নিতেন। চার-পাঁচ বৎসর পর তিনি চুঁচুড়াস্থ শ্রী উদ্ধারণ গৌড়ীয় মঠে কিছুদিনের জন্য শ্রীল ত্রিবিক্রম মহারাজের নিকট আমাকে সেবক রুপে পাঠান। সকল মহারাজ ও প্রভু-গণের নিষেধ সত্ত্বেও গুরু বৈষ্ণব আজ্ঞা শিরোধার্য জেনে নির্ভয়ে গেলাম। শ্রীল ত্রিবিক্রম মহারাজ প্রচন্ড রাগী কঠর প্রকৃতির হলেও আমাকে স্নেহ প্রীতি দিয়ে শ্রী চরণে স্থান দিলেন। শ্রীল নারায়ণ মহারাজের কৃপায় শ্রীল ত্রিবিক্রম মহারাজের সেবা ও স্নেহ পেলাম। শ্রীল গুরু মহারাজ নাম ও দীক্ষা দিলেন, শ্রীল ত্রিবিক্রম মহারাজ শ্রী চরণে সেবা দিলেন এবং শ্রীল নারায়ণ মহারাজ সন্ন্যাস দিলেন। এই তিনজনই আমার গুরু। তিনজনই সম্বন্ধ, অবিধেয় ও প্রয়োজন তত্ত্বের শিক্ষা প্রদাতা তিন ঠাকুর। অন্তে গুরুবাণী- “দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না” দাঁত চলে গেলে বোঝা যায় দাঁতের কত প্রয়োজনীয়তা। তদ্ রুপ তাহাদের শ্রীচরণের ছত্রছায়ায় নিশ্চিন্ত ছিলাম, এখন বড় অসহায় বোধ হয়, জন্ম-জন্ম প্রভু আমার ইহাই প্রার্থনা,-
“প্রতি জন্মে করি আশা শ্রীচরণের ধুলি,”
“হেন প্রভু কোথা গেলা তিন আচার্য ঠাকুর”
(Sripad B.V. Puri Maharaja is a diksa disciple of Śrīla B.V. Vamana Gosvami Maharaja and was the personal sevak of Śrīla B.V. Trivikrama Gosvami Maharaja)