Śrī Śrīmad Bhaktivedānta Nārāyana Gosvāmī Mahāraja  •  100th Anniversary

Sripad B.V. Sadhu Maharaja

India, Navadvipa

শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গৌ জয়ত:

বিশ্ববরেণ্য আচার্য্যভাস্কর ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিবেদান্ত নারায়ন গোস্বামী মহারাজের আবির্ভাব-শতবার্ষিকীতে তাঁহার স্মরণ

পরমারাধ্যতম পরম কারুণিক শ্রীশ্রীল গুরুপাদপদ্ম আচার্য্য কেশরী ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিপ্রজ্ঞান কেশব প্রভুবরের শ্রীচরণকমল স্মরণপূর্ব্বক তাঁহারই কৃপাধন্য বিশ্ববরেণ্য আচার্য্য ভাস্কর ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিবেদান্ত নারায়ন গোস্বামী মহারাজের অপ্রাকৃত জীবনাদর্শের কিছু কথা তাঁহার শুভ আবির্ভাব-শতবর্ষ-পূর্ত্তি উপলক্ষে স্মৃতিচারণের জন্য প্রয়াসী হইতেছি| আমার এই প্রয়াস তখনই সার্থক হইবে, যদি শ্রীগুরুপাদপদ্মের কৃপা ও তাঁহার কৃপা আমার প্রতি বর্ষিত হয়| তাই স্মৃতিচারণের প্রারম্ভে আমি তাঁহাদের উভয়েরই কৃপা আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।

প্রপূজ্যচরণ শ্রীল মহারাজজী বিহার প্রদেশের কোন এক পুণ্যভূমির সম্ভ্রান্ত পরিবারে, বর্ণ শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ কূলে আবির্ভূত হইয়া সেই কুলকে পবিত্র করেন। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে-“কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা বসুন্ধরা সা বসতিশ্চ ধন্যা| নৃত্যন্তি স্বর্গে পিতর প্রীতেষাম যেষাং কূলে বৈষ্ণব নামধেয়|”

বাস্তবিকপক্ষে পরমপূজ্যপাদ শ্রীল মহারাজের এই জাতিয় প্রাকৃত কোন বর্ণের অভিমান ছিল না। তিনি তাঁর শ্রীহরিকথার মধ্যে প্রায়ই বলতেন,-

“নাহং বিপ্রো ন চ নরপতিনার্পি বৈশ্যো ন শূদ্র নাহং বর্ণী ন চ গৃহপতির্ণো বনস্থ যতির্বা|

কিন্তু প্রোদ্যনিখিল পরমানন্দ পূর্নামৃতাব্ধে গোপীভর্ত্তুঃ পদকমলয়োর্দাস দাসানুদাসঃ||”- এই শ্লোক অবলম্বনে আমি বা আমরা যে ভগবানের নিত্যদাস ও তিনি আমাদের নিত্য প্রভু, ইহা আমাদের স্বরূপের পরিচয়। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা মনে পড়ে, তিনি যখন সমিতির সম্পাদক রূপে শ্রীদেবানন্দ গৌড়ীয় মঠে অবস্থান করিতেছিলেন, প্রতিদিন বিকালবেলা শ্রীমদ্ভাগবতগীতা, ভাগবত, গৌড়ীয় কন্ঠহার, জৈবধর্ম প্রভৃতির উপর ক্লাস নিতেন। জীবের নিত্যধর্ম কি? এই প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন রাখেন- তোমারা সার কথায় সংক্ষিপ্তভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দাও| তখন বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে উত্তর দিলেন, সর্ব্বশেষে তিনি আমাকে বললেন তুমি এর উত্তর দাও| আমি তদুত্তরে বললাম, “কৃষ্ণ দাসত্বই জীবের নিত্যধর্ম|” তখন তিনি বল্লেন-হ্যাঁ এই ভাবেই সারকথায় উত্তর দিতে হবে| কথাপ্রসঙ্গে আমি আমার নিজের কথা কিছু বলে ফেললাম, সেইজন্য আপনারা আমার অপরাধ মার্জ্জনা করবেন।

শ্রীধাম নবদ্বীপে অবস্থানকালে তিনি কিভাবে সেবকগণকে নিজের আচরণের মাধ্যমে সেবায় উদ্ভূত করতেন তার একটা নিদর্শন আমি আপনাদের নিকট বলছি| শ্রীদেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের প্রধান তোরন শ্রীনরহরি তোরণে প্রবেশ করে, গেটের দুই সাইডে ফুলের বাগান, একদিকে গোলাপ বাগান, আরেকদিকে রজনীগন্ধার বাগান| ঐ বাগানে ঘাস হয়েছে, কেউ পরিষ্কার করছে না, দুপুর বেলায় সবাই যখন বিশ্রাম করছেন সেই সময় মহারাজ নিজে একটা নিড়ুনী নিয়ে ঘাস তুলতে আরম্ভ করেছেন| আমরা যখন ক্লাসের জন্য এসে দেখি মহারাজ এই উক্ত সেবায় ব্রতী হয়েছেন তখন আমরা বললাম মহারাজ, এই সেবাটা আপনার যোগ্য নয়, আমরা এই সেবাটা করব। তদুত্তরে মহারাজ বললেন, আমার গুরুদেব বলতেন “জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্য্যন্ত সব সেবাটাই প্রকৃত সেবকের যোগ্য সেবা।”

শ্রীমন্মহাপ্রভুর নির্দ্দেশক্রমে ষড় গোস্বামীগন যেভাবে ভক্তিগ্রন্থ প্রণয়ন, লুপ্ততীর্থ উদ্ধার, শ্রীবিগ্রহ সেবা প্রকাশ প্রভৃতি সেবা সম্পাদন করিয়াছিলেন, তদ্রুপ শ্রীল মহারাজ তাঁর গুরুপাদপদ্মের মনোঽভীষ্ট পূরণার্থে তাঁহার রচিত মায়াবাদের জীবনী থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ভক্তি-গ্রন্থাদি বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় প্রকাশ করিয়া প্রচার করিয়াছেন| ব্রজমন্ডলে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের বিভিন্ন লীলাস্থলির সংস্কারাদি ও শ্রীমঠ মন্দির নির্মাণ পূর্বক শ্রীবিগ্রহ সেবা প্রকাশাদির মাধ্যমে ভগবান্ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আচরিত প্রচারিত প্রেম ধর্ম্মের বাণী সমগ্র বিশ্বে প্রচার করিয়াছিলেন। বাস্তব সত্যের তিনি নির্ভীক প্রচারক ছিলেন, শাস্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্য্য বিশ্লেষণ করতেন। বাস্তব সত্যকথা বলতে তিনি পশ্চাৎপদ হতেন ন। একাধারে তিনি যেমন শাস্ত্রবিরুদ্ধ সিদ্ধান্তকে ‘বজ্রাদপি কঠোরের’-ন্যায় প্রতিহত করেছেন, আবার তিনি ‘মৃদুনাকুসুমাদপির’-ন্যায় স্নেহ-প্রীতি-বাৎসল্যে তাঁর সতীর্থ গুরু ভ্রাতাগণ ও আশ্রিত সেবকগণের হৃদয়ের মনিকোঠায় আজও বিরাজমান রয়েছেন।

শ্রীল গুরুপাদপদ্মের অন্তর্ধানের পর তাঁর অভাবটা যেমন শিষ্যের হৃদয়টাকে উদ্বেলিত করে বা শূন্যতা অনুভব হয়, সেস্থানে আমরা যেমন শ্রীল বামন গোস্বামী মহারাজ কে পেয়েছি, তেমনই শ্রীল নারায়ন গোস্বামী মহারাজের অবদানও কোন অংশে কম নয়। সম্প্রতি তাঁর দু-একটা কথা না বলে পারছি না| তিনি কিভাবে আমাকে পরমার্থিক পত্র বা উপদেশের দ্বারা আশ্রম জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন–– তাঁহার দৃষ্টান্ত ব্রহ্মচারী অবস্থায় আমাকে তিনি প্রথমে গৈরিক বসন ধারণে উদ্বুদ্ধ করেন, শ্রীধাম নবদ্বীপ পরিক্রমা প্রচারকার্যে নিযুক্ত করেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণের ক্ষেত্রেও তিনি আমার বিশেষ প্রেরণা দাতা। তিনি যদি এই অধমের প্রতি তাঁর কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ না করতেন, তাহলে হয়তো আমি মায়ার পঙ্কিল আবর্তে আবর্ত্তিত হয়ে পড়তাম। তাই তাঁর অহৈতুকী কৃপার কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।

তিনি যে যথার্থ ব্রজরস রসিক বা বৃষভানুনন্দিনী শ্রীমতি রাধারানী ও ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীশ্যামসুন্দরের অন্তরঙ্গ প্রিয়জন, সে বিষয়ে আমরা অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করিতে না পারিলেও বহিরঙ্গ ভাবে কিয়ৎ পরিমাণে উপলব্ধি করিতে পারিতাম| যখন তিনি অত্যন্ত প্রীতি সহকারে মঙ্গলাচরণ, বন্দনা ও স্তবস্তুতি ও শ্রীহরিকথা কীর্ত্তন করতেন তখন অনুভব করতাম তার স্তব-স্তুতি ও শ্রীহরিকথার মধ্যে কত অনুভূতি ছিল। তিনি যেন সেই বিষয়বস্তু অন্তরে অনুভব করতেন, এবং অন্যকে অনুভব করাইবার মত যোগ্যতা রাখতেন। একবার শ্রীদামোদর ব্রত উপলক্ষে শ্রীব্রজমন্ডল পরিক্রমায় পরমপূজ্যপাদ নিত্যলীলাপ্রবিষ্ট ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ ভক্তিজীবন জনার্দ্দন গোস্বামী মহারাজ, পূজ্যপাদ শ্রীভক্তিবেদান্ত ত্রিবিক্রম মহারাজ প্রভৃতি অন্যান্য বৈষ্ণবগণ ও উপস্থিত ছিলেন। আমাদের পরিক্রমা তখন বিভিন্ন ধর্ম্মশালায় থেকে করা হতো। পরিক্রমা পার্টি নন্দগাও অবস্থানকালে একদিন বৈকালিক কীর্ত্তনের পর পরমপূজ্যপাদ শ্রীল নারায়ন মহারাজজী শ্রীনন্দবাবা ও শ্রীযশোমতী মায়ের প্রেম ও বাৎসল্যের কথা বলতে বলতে এমনই ভাবাবিষ্ট হয়েছেন যে নিজেকে তিনি আর ধৈর্য্য ধারণ করতে পারছেননা, অঝর নয়নে ক্রন্দন করছেন। পূজ্যপাদ জনার্দ্দন মহারাজ, ত্রিবিক্রম মহারাজও ক্রন্দন করছেন। তাঁদের এই প্রকারঅবস্থা দেখে আমরাও অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলাম, সেদিনের সে কথা ভাষায় ব্যক্ত করবার নয়, সে বিষয়টা ছিল অনুভবের। তাঁহার অপ্রাকৃত জীবনের বহু অলৌকিক ঘটনা সব রয়েছে, তাঁহার অন্তরঙ্গ প্রিয়জন সে বিষয়ে আপনাদের নিকট বর্ণন করবেন। আমি সংক্ষিপ্তভাবে দু-একটা কথা বর্ণন করতে চেষ্টা করলাম মাত্র। পরমপূজ্যপাদ শ্রীল নারায়ণ মহারাজ আমাদের ন্যায় মায়াবদ্ধ জীবগনের মঙ্গলের নিমিত্ত ভগবদ্ আজ্ঞাক্রমে ইহ জগতে আগমন করেছিলেন। “মহন্তের স্বভাব হয় তারিতে পামর।” তাঁহাদের আবির্ভাব ও তিরোভাব একই তাৎপর্য্যপর। তাই তাঁর শুভ আবির্ভাব শতবার্ষিকীতে ও এই অধমের হৃদয়ে তাঁর বিরহের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়। হে পরম করুণাময় পতিতপাবন অপ্রাকৃত ব্রজরসিক শ্রীরাধা বিনোদৈকজীবন, মাদৃশ অধমের প্রতি আপনার সামান্যতম কৃপাদৃষ্টি বর্ষণে কৃতার্থ করুন, ইহাই আপনার শ্রীচরণে মাদৃশ অধমের সকাতার প্রার্থনা ও নিবেদন ।

ইতি,

শ্রীগুরু-বৈষ্ণব-দাসানুদাস

ভক্তিবেদান্ত সাধু

নবদ্বীপ, নদীয়া